ত্বকের শুষ্কতা দূর করার ঘরোয়া উপায়
আমাদের ত্বক তিনটি স্তরে গঠিত যেমন এপিডার্মিস, ডার্মিস এবং হাইপোডার্মিস। এপিডার্মিস সবচেয়ে বাইরের আবরণ, ডার্মিস হলো মাঝের স্তর এবং হাইপোডার্মিস সবচেয়ে ভেতরের স্তর যা সাবকিউটেনিয়াস ফ্যাট লেয়ার নামে পরিচিত। ত্বকের এই তিনটি স্তরের এর-ই আলাদা আলাদা কাজ রয়েছে। ত্বকের শুষ্কতা দূর করার ঘরোয়া উপায় জানলে আপনার ত্বক থাকবে প্রানবন্ত।
ত্বকের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত আদ্রতা প্রয়োজন, যেমন দরকার হয় শরীরের ভিতরে অঙ্গ গুলোর জন্য। তাই আপনার সুস্থতার জন্য ত্বকের আদ্রতা ধরে রাখা প্রয়োজন। ত্বকের শুষ্কতা দূর করার ঘরোয়া উপায় নিয়ে আমরা এই প্রবন্ধে আলোচনা করব।
ত্বকের গঠন ও কার্যাবলী জেনে নেওয়া যাক:
এপিডার্মিস বা ত্বকের বাইরের আবরণের মধ্যে মেলানোসাইটস রয়েছে যা আমাদের ত্বকের রং বা কালার নির্ধারণ করে। এই মেলানোসাইটস এর উপস্থিতির জন্য কালো বা ফর্সা রং নির্ধারিত হয়। ত্বকের এর মাঝখানের স্তর বা ডার্মিস ত্বককে শক্তিশালী করে এবং ফ্লেক্সিবিলিটি দেয়। এই স্তরের মধ্যেই সংবেদনশীল রিসেপ্টর রয়েছে যার মাধ্যমে আমরা ব্যথা বা স্পর্শ অনুভব করতে পারি। হাইপোডার্মিস বা ত্বকের ভেতরের অংশ আমাদের শরীরকে সুরক্ষিত রাখে।
কেন ত্বকের আদ্রতা প্রয়োজন?
ত্বকের সঠিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সঠিক মাত্রার আদ্রতা প্রয়োজন। শুষ্ক ত্বক এর ন্যাচারাল বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এর ফলে ত্বক দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ইলাস্টিসিটি কমে যায়, যা ত্বকের প্রদাহ, ফেটে যাওয়া, এমনকি রক্তপাত ও হতে পারে। এগুলো স্কিন ইনফেকশন এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে।
যেখানে ত্বকের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সঠিক আদ্রতার প্রয়োজন, সেখানে শুষ্ক ত্বকে তা সম্ভব নয়। ঠান্ডা আবহাওয়া, সূর্যতাপ, পানিশূন্যতা এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার কারণে ত্বক শুষ্ক হতে পারে। কিন্তু আশার কথা এই যে, ত্বক সুস্থ রাখতে এবং শুষ্ক হতে প্রতিরোধ করতে অনেকগুলো উপায় রয়েছে। কিছু নিয়ম মেনে চললে আমরা সহজেই ত্বকের আদ্রতা ধরে রাখতে পারব ও ত্বকের শুষ্কতা দূর করতে পারবো।
আমাদের ত্বক কিভাবে প্রাকৃতিক ভাবেই আদ্র থাকে:
ত্বকের বাইরের স্তর বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে। পরিবেশে অনেক ক্ষতিকর কেমিক্যাল থাকে, এছাড়াও সূর্য রশ্মি পলিউশন এগুলো থেকে ত্বক আমাদেরকে সুরক্ষা দেয়। আদ্র ত্বক সাধারণত পার্মিএবল বা সহজভেদ্য হয় যা আমাদের ত্বককে স্বাস্থ্যকর রাখে এবং সঠিক ইলাস্টিসিটি দিয়ে থাকে। ত্বকের মধ্যে এমন উপাদান রয়েছে যেটি প্রকৃতিগতভাবেই ত্বককে আদ্র রাখে। এগুলো ত্বকের মধ্যে পানির কনা ধরে রাখতে সাহায্য করে, এমন কি যখন একজন গরম আবহাওয়া মধ্যেও থাকে। ত্বক প্রকৃতিগতভাবেই পানি ধরে রাখে এবং আপনার ত্বককে সঠিক আদ্রতা দেয়।
কিভাবে ত্বকের শুষ্কতা দূর করে আপনার ত্বকের সঠিক আদ্রতা ধরে রাখবেন?
পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে:
পর্যাপ্ত এবং প্রচুর পানি পান করা-ই ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায়। আমাদের ত্বকের 30 শতাংশই পানি, কিন্তু এই পানি ঘামের মাধ্যমে বেরিয়ে যেতে পারে। তাই সর্বোচ্চ আদ্রতা ধরে রাখার জন্য প্রচুর পানি পান করা উচিত। একটি স্টাডিতে দেখা যায় যে, ত্বকের উপর ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করলে যে ফল পাওয়া যায়, প্রচুর পানি পান করলে ত্বককে ঠিক তেমনি আদ্র রাখা যায়। ত্বকের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সুষম খাবারের সাথে প্রচুর পানি পান করা উচিত। তাই আপনার দেহের প্রয়োজন অনুসারে পানি পান করুন এবং আপনার ত্বক সুস্থ রাখুন।
ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে পারেন:
ত্বকের আদ্রতা ধরে রাখতে মশ্চারাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে যা ত্বকের উপর একটি প্রলেপ সৃষ্টি করে। পেট্রোলিয়াম সমৃদ্ধ পণ্য ব্যবহারে মশ্চারাইজার ঠিক থাকে যা ত্বকের পানিকে ধরে রাখে। এটি বিভিন্ন চর্ম রোগ প্রতিহত করতে সহায়তা করে বিশেষ করে এটোপিক ডার্মাটাইটিস, একজিমা ইত্যাদি।
একজিমা হলো ত্বকের একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ যার ফলে ত্বক লাল হয়, চুলকায় এবং ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। ফলে ত্বকে ইনফেকশন এর সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
হিউমিডিফায়ার ব্যবহার:
জীবনযাত্রার ধারা, আবহাওয়া, সূর্যতাপ, এছাড়া আরও অনেক বিষয় ত্বক কে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে আবহাওয়া আপনার ত্বকের উপর একটি বড় প্রভাব ফেলে। যেমন কম তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা ত্বককে শুষ্ক করে দেয় এবং হিউমিডিটি ধরে রাখতে ত্বকের উপর যে আবরণ থাকে তা নষ্ট করে দেয়। ঠান্ডা এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় ত্বকের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ঠান্ডা এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় হিউমিডিফায়ার ব্যবহার একটি সমাধান হতে পারে।
সঠিক স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে হবে:
চার ধরনের পণ্য ত্বকের উপর ব্যবহার করা যায় আদ্রতা ধরে রাখার জন্য। এগুলো হলো ক্রিম, লোশন, অয়েন্টমেন্ট এবং জেল। মুখমন্ডল এবং শরীরে ব্যবহারের জন্য লোশন হচ্ছে একটি ভালো পণ্য এবং দিনের বেলা ব্যবহার করার জন্য ভালো। এটি শেভিং এরপর ব্যবহার করা যেতে পারে এবং এটি অত্যন্ত কার্যকর। ক্রিম সাধারণত রাতে ব্যবহার করার জন্য সবচেয়ে ভালো এবং এটি মুখমন্ডলের জন্য উপযোগী। অয়েনমেন্ট এবং জেল সাধারণত ত্বকে কম ব্যবহার করা হয় আদ্রতা ধরে রাখার জন্য। অয়েন্টমেন্ট এর মধ্যে একটি চটচটে বা আঠাল ভাব রয়েছে, ফলে অনেকেই এটি ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। জেল সাধারণত মুখে ব্যবহার করা হয় কারণ এটি খুব দ্রুত শোষিত হয়।
ক্লিনজার:
তৈলাক্ত ত্বক বা অয়েলি স্কিনে সাধারণত জেল ভালো কাজ করে। এবং সেইসাথে ক্লিনজার ব্যবহার করা জরুরী কারণ ক্লিনজার মুখমন্ডলকে শুষ্ক হতে দেয় না। যারা ব্রণের সমস্যায় ভুগছেন তাদের ত্বক আর্দ্র রাখতে এর ব্যবহার সাজেস্ট করা যেতে পারে। সহজ কথায় বলা যায় যে, ক্রিম এবং লোশন নির্ভর ক্লিনজার স্বাভাবিক ত্বক এবং শুষ্ক ত্বকে ব্যবহার করা যায়।
সানস্ক্রিনের ব্যবহার:
ত্বকের আদ্রতা রক্ষায় সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। সানস্ক্রিন আপনার ত্বককে শুষ্ক হতে এবং গরম আবহাওয়া হতে সুরক্ষা দিবে। এছাড়াও সূর্যের সংস্পর্শে গেলে ক্ষতিকারক সূর্য রশ্মি থেকে সানস্ক্রিম আপনাকে সুরক্ষা দিবে।
ত্বকের শুষ্কতা দূর করার কিছু ঘরোয়া উপায়:
- হাইড্রেটেড থাকার জন্য ত্বকের যত্ন নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরী। সেই সাথে স্বাস্থ্যকর খাবার, ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার, ধূমপান পরিহার করা, এগুলো জরুরি।
- দীর্ঘদিন ধরে এক্সট্রিম ওয়েদারে থাকা ঠিক নয়। অতিরিক্ত ঠান্ডা বা অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া পরিহার করা উচিত।
- অতিবেগুনি সূর্য রশ্মি থেকে আপনার ত্বককে সুরক্ষিত রাখুন। কারণ এগুলো দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শ ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। যখন আপনি দীর্ঘ সময় ঘরে বাইরে থাকবেন চেষ্টা করবেন কিছু সময়ের জন্য ঘরের ভেতরে অবস্থান এর জন্য।
- যে সকল খাবার পানি সমৃদ্ধ বা যে সকল ফলের মধ্যে প্রচুর রস রয়েছে সেগুলো বেশি খাওয়া উচিত। কারণ এগুলো আপনার ত্বককে হাইড্রেটেড রাখবে। কিছু কিছু ফল এবং সবজিতে প্রচুর পরিমাণ পানি রয়েছে যা আপনার ত্বককে ময়েশ্চারাইজ রাখতে সাহায্য করবে।
- মুখমন্ডল ধোয়ার জন্য বা গোসল করতে ঠান্ডা পানি বা ঈষৎ গরম পানি ব্যবহার করুন, কারণ গরম পানি আপনার ত্বককে শুষ্ক করে দিতে পারে। গরম পানির ব্যবহার আপনার ত্বকের আর্দ্রতা কমিয়ে দিয়ে আরও শুষ্ক করে দিতে পারে।
- যদি সম্ভব হয় বাড়িতে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন। বিশেষ করে শীতের সময়ে বাতাসের আদ্রতা অনেক কমে যায় যার ফলে ত্বক ও অনেক বেশি শুষ্ক হয়ে যায়। বাড়িতে একটি হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করলে আপনি অতিরিক্ত হিউমিডিটি পাবেন।
ত্বকের শুষ্কতা দূর করার ঘরোয়া উপায় জানলে সহজেই আপনি ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারবেন, আর এর জন্য নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া অত্যন্ত জরুরী। নিয়মিত ত্বকের যত্ন নেয়া, সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা, প্রচুর পানি পান করা, এগুলোই হতে পারে কার্যকর সমাধান। যেকোনো একটি অনুসরণ করলে এর কার্যকারিতা নাও পাওয়া যেতে পারে। ত্বকের শুষ্কতা দূর করার ঘরোয়া উপায় নিশ্চয় আপনার কাজে লাগবে তবে এর জন্য নিজের প্রতি আরো বেশি যত্নশীল হোন।
Post a Comment