ডায়াবেটিস কমানোর প্রাকৃতিক উপায়
জীবনযাত্রা এর সাথে ডায়াবেটিস এর সম্পর্ক:
ব্লাড সুগার লেভেল নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আপনার ডক্টর সুগারের মাত্রা যে লেভেলে রাখতে বলেছেন অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে তা যেন সেই মাত্রাতেই থাকে। আমরা অনেক ভাবেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারি যেমন শারীরিক পরিশ্রম, ঔষধ সেবন অথবা ইনসুলিন গ্রহণের মাধ্যমে। লাইফস্টাইল বা জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের উপায় আমাদের জানা দরকার আমরা এই প্রবন্ধে তা-ই আলোচনা করব।
অনেকগুলো ফ্যাক্টর ব্লাড সুগার বৃদ্ধির জন্য দায়ী। কখনো কখনো অপ্রত্যাশিতভাবে ব্লাড সুগার লেভেল স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। ব্লাড সুগারের সাথে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি সম্পর্কিত সেগুলো হলো খাবার, ব্যায়াম, ঔষধ, শারীরিক সুস্থতা, মানসিক চাপ ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো যদি আমরা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলেই ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
খাবার:
কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার:
স্বাস্থ্য ভাল রাখতে স্বাস্থ্যকর খাবার এর কোন বিকল্প নেই। হোক সেটা ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে, অথবা স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে। কিন্তু আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনাকে জানতে হবে যে কোন খাবারগুলো আপনার ব্লাড সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল যে আপনি কি ধরনের খাবার খাচ্ছেন এবং কি পরিমাণে তা খচ্ছেন। আপনাকে শুধু স্বাস্থ্যকর ভালো খাবার খেলেই হবে না তা অবশ্যই পরিমাণমতো খেতে হবে। কারণ মাত্রাতিরিক্ত খাবার আপনার রক্তের Glucose এর মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাহলে এখন প্রশ্ন হল যে আমাদের কি করতে হবে। আমাদের যা করতে হবে তা হল -
কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের উপর লক্ষ্য রাখতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্বোহাইড্রেট একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এখানে কার্বোহাইড্রেট একটি key ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। কারণ ব্লাড Glucose এর উপর কার্বোহাইড্রেট এর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। একজন ডায়াবেটিস পেশেন্ট কে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, তার খাবারে কতটুকু কার্বোহাইড্রেড রয়েছে। এছাড়াও আপনি কতটুকু প্রোটিন খাচ্ছেন সেটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই খাবার গ্রহণের সময় খাবার এর পরিমাণ নির্ধারণের জন্য পরিমাপক কাপ ব্যবহার করুন। আপনার শরীরে কি পরিমান কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন প্রয়োজন তা জানার জন্য একজন চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।
একটা ব্যালেন্স ডায়েট এর প্ল্যান করুন:
আপনার খাবারের মধ্যে যেন ব্যালেন্স ডায়েট থাকে তা লক্ষ্য করুন। এই খাদ্যতালিকায় যেন ফল, শাকসবজি, স্টার্স, প্রোটিন, ফ্যাট, সবগুলোই পরিমাণমতো থাকে তা খেয়াল রাখতে হবে। এখানে কার্বোহাইড্রেট এর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। ফল, শাকসবজি, এবং হোল গ্রেইন থেকে যে কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায়, তা অন্যান্য কার্বোহাইড্রেট থেকে বেশ ভালো।
ঔষধ এবং খাবার এর মধ্যে একটি সমন্বয় করতে হবে:
আপনি যে ওষুধ খাচ্ছেন তার সাথে সমন্বয় করে খাবার গ্রহণ করতে হবে বিশেষ করে ইনসুলিন এর ক্ষেত্রে। অনেক বেশি খাবার গ্রহণ আপনার ব্লাড সুগার লেভেল কে অনেক বেশি বাড়িয়ে দিতে পারে। ওষুধের পাশাপাশি আপনার খাবার এর পরিমান কতটুকু হবে তা জানতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সুগার বা চিনি সমৃদ্ধ খাবার-পানীয় পরিহার করুন:
বেশিরভাগ কার্বোনেটেড বেভারেজ এর মধ্যে অনেক বেশি পরিমাণ সুগার এবং অনেক বেশি ক্যালরি থাকে। অপরপক্ষে খুব কম পরিমাণে পুষ্টিগুণ থাকে। এ সকল খাবার দ্রুত ব্লাড Glucose কে বাড়িয়ে দেয় তাই সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এগুলো পরিহার করা। চিনি সমৃদ্ধ খাবার বা পানীয় যেমন সোডা, স্পোর্ট ড্রিঙ্ক, জুস, এগুলো দ্রুত ব্লাড Glucose বাড়াতে সহায়তা করে। তাই যতটা সম্ভব এগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো।
শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম:
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যখন আপনি ব্যায়াম করেন তখন আপনার এনার্জি লস হয় এতে Glucose এর মাত্রা কমে। আপনার শরীর যেন ইনসুলিন কার্যকরভাবে শরীরে কাজে লাগাতে পারে সে জন্য শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম আপনার ব্লাড Glucose লেভেল কমাতেও সাহায্য করে। কিন্তু অল্প পরিশ্রমের কাজ যেমন ঘরের ভেতরের কাজ, বাড়িতে ছোটখাটো কাজ ব্লাড সুগার কে বাড়াতে পারে। এখন তাহলে প্রশ্ন আসে যে কিভাবে শারীরিক পরিশ্রম বা এক্সেসাইজ করতে হবে। আমাদের যা করতে হবে তা হল -
পরিকল্পনা মাফিক এবং নিয়ম করে ব্যায়াম করা:
স্বাভাবিকভাবে প্রতি সপ্তাহে 150 মিনিট শারীরিক একটিভিটি বা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। বেশিরভাগ দিন এই চেষ্টা করতে হবে জানো কমপক্ষে 30 মিনিট শারীরিক পরিশ্রম বা হাঁটতে পারেন। আপনি কি ধরনের ব্যায়াম করবেন বা ঠিক কতটুকু এক্সারসাইজ আপনার প্রয়োজন তা জানতে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। আপনি যদি অনেক লম্বা সময় কর্মবিমুখ থাকেন বা শারীরিক অ্যাকটিভিটিতে তেমন অ্যাক্টিভ না থাকেন, তাহলে আপনার ডক্টর আপনার শরীর সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করবেন এবং সে অনুযায়ী উপদেশ দিবেন। আপনি দিনের ঠিক কোন সময়ে শারীরিক পরিশ্রম করবেন অথবা হাঁটবেন তার একটা সময় নির্ধারণ করুন। লক্ষ্য রাখবেন যেন প্রত্যেকদিন সেই সময়ে অবশ্যই এই কার্যক্রম করতে পারেন। সঠিক সময় এর ব্যাপারে আপনার চিকিৎসক আপনাকে নির্দেশনা দিতে পারবেন। আপনি যদি এ ধরনের কাজে অভ্যস্ত না থাকেন তাহলে তা পর্যায়ক্রমে শুরু করুন। কারণ জীবনযাত্রা পরিবর্তন করেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব।
ব্লাড সুগারের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করুন:
শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম এর আগে, পরিশ্রম করার সময় এবং পরিশ্রম করার পরে আপনার রক্তের Glucose এর মাত্রা পরীক্ষা করুন। শারীরিক পরিশ্রম আপনার ব্লাড এর Glucose এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করবে। আবার আপনার ব্লাড Glucose এর মাত্রা যেন একেবারে নিচে নেমে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। দুর্বলতা, ক্লান্তি অনুভব, ক্ষুধা, অস্বস্তিকর অবস্থায়, রাগান্বিত হওয়া, কনফিউজ হাওয়া, এগুলো ব্লাড সুগার এর মাত্রা বেশি কমে যাওয়ার লক্ষণ।
নিজেকে সতেজ রাখুন:
প্রচুর পানি পান করা সহ অন্যান্য পানি সমৃদ্ধ ফল ও শাকসবজি গ্রহণ করুন। কারণ পানিশূন্যতা ব্লাড সুগার লেভেল কে প্রভাবিত করতে পারে।
সর্বদাই নিজেকে প্রস্তুত রাখুন:
কখনো কখনো হঠাৎ আপনার ব্লাড Glucose এর মাত্রা একেবারে কমে যেতে পারে। সুতরাং সঙ্গে কিছু স্ন্যাক্স বা হালকা খাবার রাখুন কারণ হঠাৎ ব্লাড Glucose এর মাত্রা কমে গেলে এটা ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করবে।
প্রয়োজনীয় ঔষধ মজুদ রাখুন:
আপনি যদি ইনসুলিন গ্রহণ করেন তবে তা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করুন কারণ ইনসুলিন তাপমাত্রার ব্যাপারে অতি সংবেদনশীল।
অসুস্থতায়:
যখন আপনি অসুস্থ হন তখন আপনার স্ট্রেস সংক্রান্ত হরমোন রোগের বিরুদ্ধে আপনাকে ফাইট করতে সহায়তা করে। সেইসাথে এটা আপনার ব্লাড সুগার লেভেল কে বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই আপনি অসুস্থ হলে কি খাবার গ্রহণ করবেন অথবা কতটুকু শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে তা চিকিৎসকের কাছে জেনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে যদি কোন ঔষধের ডোজ এডজাস্ট করতে হয় তাও আপনার চিকিৎসক করে দেবেন।
অসুস্থ হলেও আপনি প্রচুর পরিমাণ তরল গ্রহণ করুন যেমন চা বা অন্যান্য পানীয়। প্রচুর পানি পান, অসুস্থ অবস্থায় ও আপনাকে সতেজ রাখবে। অবশ্যই চিনি সমৃদ্ধ খাবার বা পানীয় যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।
অ্যালকোহল বা অ্যালকোহল মিশ্রিত খাবার এড়িয়ে চলুন:
ব্লাড সুগার লেভেল কমে গেলে আপনার লিভার আপনাকে সঞ্চিত সুগার সরবরাহ করবে। অ্যালকোহল পানে এই কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং অ্যালকোহল ব্লাড সুগার লেভেল কে দ্রুত কমিয়ে দিতে পারে। তাই ডায়াবেটিক পেশেন্টের অবশ্যই অ্যালকোহল পরিহার করা উচিত।
ঋতুস্রাব এবং মেনোপজ এর সময়:
হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ঋতুস্রাবের সময় এবং মেনোপজ এর সময় ব্লাড সুগার লেভেল এফেক্ট করতে পারে। তাই এ সময় ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা তা চেক করে দেখতে হবে। মেনোপজের সময় অথবা মেনোপজ এর কিছু পরেই ব্লাড সুগার লেভেল ঠিক আছে কিনা তা ঘনঘন চেক করা উচিত। এ ব্যাপারে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নিন।
মানসিক চাপ:
দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ ব্লাড সুগার লেভেল কে প্রভাবিত করতে পারে এবং তা আপনার ব্লাড সুগার লেভেল কে বাড়িয়েও দিতে পারে। জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে ডায়াবেটিস কমাতে হলে অবশ্যই আপনাকে মানসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে।
যদি আপনি বুঝে ফেলেন যে মানসিক চাপ আপনার ব্লাড সুগার কে প্রভাবিত করছে তাহলে অবশ্যই রিলাক্সেশন টেকনিক আয়ত্ত করে ফেলুন। যেন আপনি নিজেই আপনার মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম অনেক সময় মানসিক চাপকে কমিয়ে দেয়। তাই মানসিক চাপ কমিয়ে ফেলুন এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
***এই প্রবন্ধে যে বিষয়গুলো আলোচিত হলো তা ক্লিনিক্যালি রোগ নির্ণয় বা মেডিকেল ট্রিটমেন্ট নয়। এই তথ্যগুলো শুধুমাত্র আপনার জানার জন্য এবং শিক্ষার জন্য। রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা পেতে অবশ্যই আপনার চিকিৎসক এর সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
আসলে অনেকগুলো বিষয় আমাদের ব্লাড সুগার লেভেল কে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কিছু বিষয় আছে যা ব্লাড সুগার লেভেল কে প্রভাবিত করে বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। লাইফ স্টাইল বা জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং অবশ্যই তা নির্ভর করবে আপনার ইচ্ছার উপর। কিভাবে আপনি আপনার লাইফ লিড করবেন তা আপনার উপরেই নির্ভর করে। তাই জীবনযাত্রা পরিবর্তন করুন এবং সুস্থ ও সুন্দর থাকুন।
