কোন ভিটামিনের অভাবে ঘুম কম হয়? অনিদ্রার কারণ
অনিদ্রা কি?
নিদ্রাহীনতা হল একটি সাধারণ ঘুমের সমস্যা যার ফলে ঘুমাতে কষ্ট হয়, বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থাকা যায় না অথবা ঘুমালেও খুব দ্রুত ঘুম ভেঙে যায়। এছাড়াও ঘুম থেকে উঠার পর আপনি ক্লান্তি অনুভব করবেন কারণ আপনি ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি। আসলে নিদ্রাহীনতার অনেক কারণ আছে। আমরা এই প্রবন্ধে নিদ্রাহীনতার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। নিদ্রাহীনতা আপনার এনার্জি লেভেল কে কমিয়ে দিতে পারে, যা আপনার স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এটা আপনার কাজের গতিকে কমিয়ে দিতে পারে, সেই সাথে জীবন যাত্রার মান কমিয়ে দিতে পারে।
অনেকের খুব অল্প সময়ের জন্য অনিদ্রা হয়, যা একদিন হতে এক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটা অনেক সময় মানসিক চাপের কারণে হয়ে থাকে। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে অনেক লম্বা সময় অনিদ্রা হয় যে এক মাস থেকে শুরু করে কয়েক মাস ব্যাপী স্থায়ী হতে পারে। দীর্ঘদিন এই অনিদ্রা স্থায়ী হলে আপনি বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারেন। আপনার কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন করলেই এই সমস্যা সহজে কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
কি পরিমান ঘুমের প্রয়োজন?
বয়সভেদে ঘুমের মাত্রার তারতম্য রয়েছে তবে একজন স্বাভাবিক মানুষের প্রতিদিন 7 থেকে 8 ঘন্টা ঘুমানো প্রয়োজন।
কি কারনে অনিদ্রা হয়?
নিদ্রাহীনতা হওয়ার জন্য আসলে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। দীর্ঘদিনের অনিদ্রার সাথে সাধারণতঃ মানসিক চাপ, মানসিক অস্থিরতা, অভ্যাস, এগুলো জড়িত। এই ব্যাপার গুলো দূর করতে পারলে অনিদ্রা সমস্যা ও সমাধান হবে।
- চাকরিস্থলে, স্কুলে, ইউনিভার্সিটি তে, ব্যবসায় বা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মানসিক চাপ অনুভব করলে অনিদ্রা হতে পারে।
- বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের সময় অনিদ্রা হতে পারে।
- যদি আপনি একেক দিন একেক সময় ঘুমোতে যান সে ক্ষেত্রে অনিদ্রা হতে পারে।
- ঘুমোতে যাওয়ার পরিবেশ ঘুমের জন্য অত্যন্ত জরুরী, তাই বেডরুমের পরিবেশ ভালো না হলে অনিদ্রা হতে পারে।
- অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ অথবা না খেয়ে ঘুমাতে যাওয়া অনিদ্রার সৃষ্টি করতে পারে। অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করলে আপনি অস্বস্তি অনুভব করবেন যে আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে।
- টিভি দেখা বা স্মার্টফোনের অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার ফলেও অনিদ্রা হতে পারে।
- অনিদ্রার আরো অনেক কারণ রয়েছে যেমন-
- দুশ্চিন্তা, অবসাদ এগুলো আপনার ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। অনেক সময় অনেকে দুশ্চিন্তার কারণে খুব দ্রুত ঘুম থেকে উঠে পড়েন।
- আবার কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেও অনিদ্রা হতে পারে।
- বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ, থাইরয়েড ডিজিজ, বুক জ্বালাপোড়া করা, এসব রোগ-ব্যাধিও নিদ্রাহীনতার কারণ হতে পারে।
- মদ্যপান, নিকোটিন গ্রহণ কখনো কখনো অনিদ্রার কারণ হতে পারে।
- ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার যেমন চা-কফি, এগুলো স্নায়তন্ত্র কে উদ্দীপ্ত করে এবং অনিদ্রার কারণ হয়।
কিভাবে বুঝবেন আপনার নিদ্রাহীনতা হয়েছে:
- আপনার অনিদ্রা বা নিদ্রাহীনতা হয়েছে, যদি আপনি দেখেন যে-
- ঘুমের সময় আপনি বারবার জেগে উঠছেন।
- ঘুমাতে যাওয়ার পর দীর্ঘক্ষন অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘুম না হওয়া।
- দিনের বেলায় ক্লান্তি অনুভব করা অথবা বারবার ঝিমুনি ভাব হওয়া।
- কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর খুব দ্রুত জেগে ওঠা।
- অস্বস্তিকর অবস্থা, হতাশা এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়া।
- রাত্রে ঘুমানোর পরও - ভালো বিশ্রাম হয় নি এরকম অনুভব করা।
- ঘুম হচ্ছে না এমন বিষয় নিয়ে বারবার দুশ্চিন্তা করা।
- রাত্রে কিছুটা ঘুম হওয়ার পরও কাজে সঠিক ভাবে মনোযোগ না দিতে পারা।
- কোন কাজ ভুলে যাওয়া অথবা সাম্প্রতিক কোন কাজ মনে করতে না পারা।
রাত্রে যদি আপনার ঘুম না হয় তাহলে দিনের কাজে মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত কঠিন। ঘুমের সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই আপনার চিকিৎসক এর পরামর্শ নিন।
বয়সের সাথে ঘুমের সম্পর্ক:
বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে:
বয়সের সাথে ঘুমের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনিদ্রার সমস্যায় বাড়তে পারে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঘুম সহ আপনার আরও অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
বয়স বাড়লে সাধারণত ঘুম কম বিশ্রাম পূর্ণ হয়। পরিবেশের যে কোনো পরিবর্তন অথবা অল্প শব্দেই ঘুম ভাঙিয়ে দিতে পারে। যুবক বয়সের মতই বৃদ্ধ বয়সেও পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন রয়েছে।
কাজ কর্মের মধ্যে পরিবর্তন:
বয়স বাড়লে অনেক সময় আপনি দৈহিকভাবে কম কার্যক্রমও হতে পারেন, আবার সামাজিক কার্যক্রমেও কম উপস্থিতি হতে পারে। দৈহিকভাবে এই কম পরিশ্রম আপনার ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে যখন আপনি কম পরিশ্রম করবেন তখন আপনি কম ক্লান্তি অনুভব করবেন।
বয়সের সাথে সাথে স্বাস্থ্যের পরিবর্তন হয়:
বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন, হাঁটুতে ব্যথা, কোমর ব্যথা, এগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। ফলে স্বভাবতই ঘুমে কিছুটা ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে। আমার বয়স্ক ব্যক্তিদের অনেক সময় প্রোস্টেট সমস্যা অথবা ইউরিনারি ব্লাডার এ সমস্যা থাকে সেক্ষেত্রে বারবার রাতে প্রসাব করার প্রয়োজন হয়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে অনিদ্রা হওয়ার এটাও একটি অন্যতম কারণ।
অতিরিক্ত ঔষধ গ্রহন:
যুবক বয়স থেকে বৃদ্ধ বয়সে সাধারণত অনেক বেশি ঔষধ খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। অনেক সময় বিভিন্ন ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনিদ্রার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে:
বড়দের মতো শিশু-কিশোরদের কখনো কখনো অনিদ্রা বা নিদ্রাহীনতা হতে পারে। তবে, এটা অনেকের অভ্যাস আছে যে, অনেক সময় শিশু-কিশোররা অনেক দেরিতে ঘুমাতে যায় এবং অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠে।
কোন ভিটামিনের অভাবে ঘুম কম হয়?
ভিটামিন ডি ও ভিটামিন বি৬ এর অভাবে ঘুম কম হতে পারে। ভিটামিন ডি শরীরের বিশ্রাম নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এই ভিটামিন এর অভাব হলে ঘুমের গুণমান খারাপ হতে পারে। অন্যদিকে, ভিটামিন বি৬ মেলাটোনিন ও সেরোটোনিন নামক হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে, যা ভালো ঘুমের জন্য জরুরি।
অনিদ্রা হলে যে ঝুঁকি গুলো রয়েছে:
হঠাৎ হঠাৎ যে কারোর-ই নিদ্রাহীনতা হতে পারে। কিন্তু এতে যে ঝুঁকিগুলো রয়েছে তা হলো-
- আপনি যদি মহিলা হন তাহলে ঋতুচক্রের সময় অথবা মেনোপজ হলে হরমোনের অনেক পরিবর্তন হয়। এটা আপনার ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় নিদ্রাহীনতা একটি সাধারণ সমস্যা।
- আপনি যদি মানসিক বা স্বাস্থ্যগতভাবে অসুস্থ থাকেন তাহলে নিদ্রাহীনতা আপনার জীবনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
- নিদ্রাহীনতা কর্ম ক্ষেত্রে আপনার কাজের গতিকে কমিয়ে দিতে পারে।
- ছাত্র ছাত্রীদের স্কুল বা কলেজে পড়াশোনায় মনোযোগ নষ্ট করে দিতে পারে।
- নিদ্রাহীন অবস্থায় ড্রাইভিং করলে অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- দীর্ঘদিনের অনিদ্রা আপনাকে হতাশা এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে দিতে পারে।
- নিদ্রাহীনতা অনেক দীর্ঘ মেয়াদী রোগের সৃষ্টি করতে পারে, যেমন হার্টের অসুখ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি।
নিদ্রাহীনতার প্রতিকার:
আপনার বয়স যাই হোক না কেন নিদ্রাহীনতা হলে তা আপনি প্রতিরোধ করতে পারবেন। এজন্য আপনার জীবনযাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। আপনাকে ঘুমের একটি ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
- ঘুমানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন, এবং প্রত্যেক দিন ঘুমানোর জন্য ওই নির্দিষ্ট সময়ে অটল থাকুন।
- দিনের বেলায় দৈহিক পরিশ্রম এর মাধ্যমে একটিভ থাকুন। দিনভর দৈহিক পরিশ্রম করলে আপনি স্বভাবতই ক্লান্তি অনুভব করবেন এবং আপনার ঘুম ভালো হবে।
- ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল ব্যবহার এর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার বা পানীয় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে তাই ঘুমের পূর্বে এগুলো পান করা থেকে বিরত থাকুন।
- যদি আপনার শরীরে কোন ব্যথা থাকে তাহলে ব্যথা নিরাময় ওষুধ গ্রহণ করুন এবং আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- ঘুমানোর পূর্বে খুব বেশি খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। ঘুমের পূর্বে খুব বেশি আহার করলে বুক জ্বালাপোড়া করার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- ঘুমানোর ঠিক পূর্বেই অনেক বেশি পানি পান করা থেকে বিরত থাকুন।
- আপনার বেডরুম ঘুমানোর জন্য আরামদায়ক করে তুলুন। আপনার বেডরুম অন্ধকার এবং শান্ত রাখুন যেন বাইরে কোলাহল ভেতরে প্রবেশ না করতে পারে।
- আপনার বেডরুম এর তাপমাত্রা ঠিক আছে কিনা তা দেখুন। অতিরিক্ত ঠান্ডা বা অতিরিক্ত গরম আপনার ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
- বেডরুম থেকে সম্ভব হলে ঘড়ি সরিয়ে ফেলুন কারণ এটা আপনার উদ্বিগ্নতা কে বাড়িয়ে দিতে পারে।
- বেডরুম থেকে টিভি সরিয়ে ফেলতে পারেন এবং বেডরুমে মোবাইল ফোন ব্যবহার হতে বিরত থাকুন।
- ঘুমানোর পূর্বে উষ্ণ গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন অথবা ঘুমানোর পূর্বে শরীরে কিছুটা মেসেজ করা যেতে পারে।
- জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করবেন না। কারণ জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা আপনার উদ্বিগ্নতা কে বাড়িয়ে দিতে পারে।
- ঘুমানোর ঠিক পূর্বেই বেড রুমে প্রবেশ করুন। আপনার ঘুমের নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে ঘুমাত গেলে
- তা আপনার অনিদ্রার কারণ হতে পারে।
*** এই প্রবন্ধে যে বিষয়গুলো আলোচনা করা হলো তা শুধুমাত্র তথ্যনির্ভর এবং জানার জন্য। প্রচলিত অর্থে এটা কোন মেডিকেল ট্রিটমেন্ট নয়। রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ঘুম আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। স্বাস্থ্যকর খাবার এবং ঘুম আমাদের স্বাস্থ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনিদ্রা আমাদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলতে পারে। আমাদের অনিদ্রা বা নিদ্রাহীনতার কারণ এবং প্রতিকার জানা দরকার যেন আমরা তা দূর করতে পারি।
Post a Comment